গঙ্গাসাগর মেলার নানান তথ্য।
নিজস্ব সংবাদদাতা, গঙ্গাসাগর : শনিবার সাগরমেলা অফিসে এক সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এদিন বিকেলে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন এবং রাজ্যের মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে গঙ্গাসাগর মেলা সংক্রান্ত বিষয় সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন। গঙ্গাসাগর মেলা ২০২৩ শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নানান তথ্য এই সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয়। শনিবার সন্ধ্যা ৬:৫৩ মিনিট থেকে পুণ্যস্নান আরম্ভ হবে এবং রবিবার সন্ধ্যা ৬:৫৩ মিনিট পর্যন্ত চলবে।
শুক্রবার রাত ৯ টা থেকে আজ সকাল ৮:৫০ মিনিট পর্যন্ত অত্যন্ত ঘন কুয়াশা থাকার কারণে কোনো লঞ্চ ও বার্জে তীর্থযাত্রী পারাপার করা যায়নি।
বিপুল সংখ্যক তীর্থযাত্রী সাগরদ্বীপে পুণ্যস্নানের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছেন। সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনায় তীর্থযাত্রীরা স্নান ও কপিল মুনির আশ্রমে পূজা অর্পণ করে নিরাপদে ফিরে যাচ্ছেন। এখনো পর্যন্ত পাওয়া প্রাথমিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী গঙ্গাসাগর মেলায় প্রায় ৩৯ লক্ষ (৩১ লক্ষ) তীর্থযাত্রী পুণ্যস্নানের উদ্দেশ্যে উপস্থিত হয়েছেন।
এবারের গঙ্গাসাগর মেলাতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সর্বাধিক সংখ্যক তীর্থযাত্রীর আগমন ঘটতে পারে ভেবেই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় ৪০,০০০ বর্গ মিটার জমি সাগরের জল থেকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পুনরুদ্ধার করা হয় এবং তীর্থযাত্রীদের স্নানে যাতে বিঘ্ন না ঘটে তার জন্য ১ নং রাস্তার বাঁ দিকে বীচ নং ১এ এবং ৫ নং বীচের ডান দিকে বীচ নং ৬ নামে স্নানের জায়গা প্রসারিত করা হয়। এই ২টি বীচ সংযোগকারী নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হয় এবং সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে শৌচালয়, আলোর ব্যবস্থা, পুলিশ ক্যাম্প, ওয়াচ টাওয়ার প্রভৃতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই উদ্যোগ নেওয়ার ফলে বিপুল সংখ্যক তীর্থযাত্রীর পুণ্যস্নান সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়।
তীর্থযাত্রীদের চলাচলের সুবিধার্থে ২,২৫০ টি বাস, ৫ টি বার্জ, ৪৪টি ভেসেল ও ১২০ টি লঞ্চ (যার মধ্যে ১০ টি ভেসেল ও ২০ টি লঞ্চ রিজার্ভে ছিল) লাগাতার যাত্রী পরিবহণ করে চলেছে। ১০টি ভেসেল ও ২০ টি লঞ্চ যা রিজার্ভে রাখা ছিল পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুযায়ী তাদের সবকটিকে কাজে লাগানো হয়েছে।
কলকাতার বাবুঘাট থেকে লট নম্বর ৮ পর্যন্ত যাত্রাপথে ১১ টি বাফার জোনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই বাফার জোনগুলিতে জেটি ঘাটে ভীড় নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দ্যেশে প্রয়োজনের ভিত্তিতে বাসগুলিকে পারাপারের আগে দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে। এই সময়ে তীর্থযাত্রীদের বিশ্রামের জন্য প্রতিটি বাফার জোনে সুবন্দোবস্ত রাখা হয়েছে।
এবারে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে,
তীর্থযাত্রীদের নিরাপদ পানীয় জল সরবরাহের উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জনস্বাস্থ্য ও কারিগরী দপ্তরের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে প্রচুর সংখ্যক পরিশ্রুত পানীয় জলের পাউচ বিতরণের সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে।
প্রায় ১২,০০০ স্থায়ী ও অস্থায়ী শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে। ৭টি কঠিন বর্জ্য পরিচালন ইউনিট, ১৮ টি ই-কার্ট, সাগরতীর পরিচ্ছন্ন রাখা এবং বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য ৪,৯৮০ জন সাফাই কর্মীকে নিযুক্ত করা হয়েছে।
১১০০ টি সিসিটিভি, ২২ টি ড্রোন, ১০ টি স্যাটেলাইট ফোন ও ১৩৮ টি ম্যানপ্যাকের মাধ্যমে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মেলার বিভিন্ন স্থানের ওপর প্রতিনিয়ত সতর্ক নজরদারী রাখা হচ্ছে।
৩০০০ জন সিভিল ডিফেন্স স্বেচ্ছাসেবক ও অসামরিক প্রতিরক্ষা দপ্তরের ১২০ জন জলপ্রহরী। তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতি মুহুর্তে সজাগ ও সতর্ক আছেন।
পুণ্যার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে প্রাথমিক চিকিৎসা এবং ২৪ ঘন্টার আই. সি. ইউ. সহ হাসপাতালের সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হয়েছে এবং ৭০০ জন স্বাস্থ্যকর্মী পরিষেবায় নিয়োজিত আছেন। জরুরী ভিত্তিতে আপৎকালীন স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিতে আছে ১ টি এয়ার এবং ৪ টি ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্সের বিশেষ ব্যবস্থা।
বিভিন্ন পরিষেবার মাঝেও চলছে গ্রিন গঙ্গাসাগর মেলা অভিযান। প্লাস্টিকমুক্ত সবুজ পরিবেশ রক্ষায় ও পরিবেশবান্ধব মেলার লক্ষে সমুদ্রতটে গ্রিন গঙ্গাসাগর মেলা অভিযান কর্মসূচী পালন করা হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিবেশ বান্ধব উপাদানে তৈরি ব্যাগ সাফাই কর্মীদের বিতরন করা হয়, যাতে তারা এই ব্যাগ গুলি সাগর মেলায় আগত তীর্থ যাত্রীদের প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবর্তে হাতে তুলে দিতে পারেন।
অন্যদিকে মেলা কে কেন্দ্র করে গ্রহণ করা হয়েছে খাদ্য সুরক্ষা অভিযান। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গুলির দ্বারা সাগর মেলায় আগত তীর্থযাত্রীদের খাদ্য বিতরণ করা হচ্ছে প্রতিদিন সেই খাদ্যবস্তু পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। তীর্থ যাত্রীদের জন্য প্রদত্ত খাবার খেয়ে তার গুণমান যাচাই করছেন সংশ্লিষ্ট আধিকারিক ও কর্মীরা। পাশাপাশি যে সমস্ত উপকরণ দিয়ে খাবার প্রস্তুত করা হচ্ছে তার মান যাচাই করছেন ফুড কোয়ালিটি ইনসপেক্টরদের একটি বিশেষ দল। এই উদ্যোগ নেওয়ার ফলে এখনো পর্যন্ত তীর্থযাত্রীদের খাদ্যে বিষক্রিয়াজনিত কোনো অসুস্থতা হয়নি।
এখনও পর্যন্ত ই-দর্শনের মাধ্যমে প্রায় ৬০.৪ লক্ষ ( ৪০.৭ লক্ষ মানুষ গঙ্গাসাগর মেলা তথ্য কপিলমুনির দর্শন করেছেন। আর ই-স্নানের মাধ্যমে ৩,৫৫৪ (১,৮৩৪ জন) জন ও ই-পূজার মাধ্যমে প্রায় ২০.৩ লক্ষ (১০.৫ লক্ষ) মানুষ এখনও পর্যন্ত ঘরে বসেই পুণ্যলাভের সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।
হারিয়ে যাওয়া মানুষের সহজে খোঁজ পাওয়ার জন্য শিশু ও বয়স্ক তীর্থযাত্রীদের প্রায় ১.৫ লক্ষ টি কিউ আর কোড স্ট্রিপ বিতরণ করা হয়েছে। যার ফলে এখনো পর্যন্ত সব হারিয়ে যাওয়া তীর্থযাত্রীরা প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় তাদের পরিজনদের খুঁজে পেতে সমর্থ হয়েছে। ৩২ জন হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যাদের প্রত্যেককে খুঁজে তাদের পরিজনেদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বন্ধনের মাধ্যমে এখনও পর্যন্ত ৮,৪০,০০০ জন (২,৩৪,৩৫০ জন) পুণ্যার্থী রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে নিজের ছবি সম্বলিত শংসাপত্র পেয়েছেন। এই শংসাপত্র তীর্থযাত্রীদের বিশেষ প্রশংসা পেয়েছে।
মহা সাগর আরতিতে গতকাল সাগরের পুণ্যতটে গঙ্গা আরতির দর্শনে প্রায় লক্ষাধিক পুণ্যার্থীর সমাগম হয়েছিল। তিনদিনব্যাপী এই মহা সাগর আরতি পুণ্যার্থীদের মনে বিপুল উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে।
এই মেলায় আধ্যাত্মিক আলোচনার জন্য আয়োজিত ‘সাগর প্রবচন’ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন এবং দেশ- বিদেশের ভক্ত সদস্যদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। সাগর প্রবচনে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, রাশিয়া, ইউক্রেন, নিউজিল্যান্ড, ব্রাজিল এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ভক্তরা অংশ নিয়েছেন। সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণে গঙ্গাসাগরের এই মঞ্চ আধ্যাত্মিক ও শান্তির বার্তা প্রচারের মঞ্চে পরিণত হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে তৈরী হওয়া বাংলার
মন্দিরে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক তীর্থযাত্রীর আগমন লক্ষ্য করা যচ্ছে। মহিলাদের সুযোগ সুবিধাকে প্রাধান্য দিতে সাগর মেলায় বিশেষ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিশুদের মাতৃদুগ্ধ পান করানোর জন্য বিভিন্ন স্থানে ‘She’-কর্ণার ও স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহকারী স্বয়ংক্রিয় ভেন্ডিং মেশিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মহিলাদের নিরাপত্তার
লক্ষ্যে ১২৯ জন মহিলা পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
বিভিন্ন ভাষাভাষীর তীর্থযাত্রীদের জন্য তথ্য সরবরাহ ও সচেতনতার উদ্দেশ্যে সাগর মেলায় ৬ টি টাওয়ার থেকে ৭ টি ভাষায় (বাংলা, হিন্দী, ওড়িয়া, মারাঠী, তামিল, তেলেগু ও ভোজপুরী) প্রতিনিয়ত ঘোষণা করা হচ্ছে।
এখনো পর্যন্ত ৪৮ জন তীর্থযাত্রী সাগরদ্বীপের বিভিন্ন হাসপাতালে অসুস্থতার কারণে ভর্তি হয়েছেন। ১২ জন তীর্থযাত্রীকে উন্নততর পরিষেবার জন্য কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এপর্যন্ত ৫ জন অসুস্থ তীর্থযাত্রীকে এয়ারলিফটের মাধ্যমে জরুরী ভিত্তিতে কলকাতার এম. আর. বাঙ্গুর হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত আগত তীর্থযাত্রীদের মধ্যে ৩ জনের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে যার মধ্যে আজ মারা গেছেন ২ জন। ১) প্রতাপ চন্দ্র গিরি (৭২) উড়িষ্যা। ২) বায়োলা দেবী (৭৩) বিহার। এখনো পর্যন্ত ২৮ টি পকেটমারীর ঘটনা ঘটেছে, যার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ধৃত বস্তু উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। চুরি যাওয়া মোট ৯৫,৩২৫ টাকা উদ্ধার হয়েছে। ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিনের সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কৃষি এবং পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, জনস্বাস্থ্য ও কারিগরী মন্ত্রী পুলক রায়, পরিবহন দপ্তর মন্ত্রী স্নেহাশীষ চক্রবর্তী, সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী বঙ্কিম চন্দ্র হাজরা, রাষ্ট্রমন্ত্রী সুজিত বোস ও ইন্দ্রনীল সেন, তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর সেক্রেটারি শান্তনু বসু, সুন্দরবন পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখার্জী, জেলাশাসক সুমিয় গুপ্তা, সভাধিপতি শামীমা শেখ।