বিপন্ন জয়নগরের মোয়া।
নাজিবুল ইসলাম মণ্ডল, জয়নগর: আবহওয়া ঘুরছে। ফলে শীত হারিয়েছে নিজস্ব চরিত্র। জয়নগর ও সন্নিহিত এলাকার প্রায় সব জায়গায় খেজুর দ্রুততার সঙ্গে কমছে। তাই রস কম, গুড় কমে গেছে। ফলে জয়নগরের মোয়া আজ বিপন্নতার গ্রাসে।মোয়ার চাহিদা বাড়ছে উত্তরোত্তর তাহলে কোথায় সংকট? মোয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল -খই। মরিশাল এবং কনকচূড় ধানের খই একমাত্র পণ্য মোয়া তৈরিতে। জয়নগর ব্লক এবং সন্নিহিত ব্লকগুলিতে কনকচূড় ধানের চাষ নেই বললে চলে। একটু দূরে মথুরাপুর, কাশিনগর, কুলপী এবং রায়দীঘি থানা এলাকার চাষিদের কাছ থেকে কনকচূড় ধান কিনতে হয়। চলতি মাঘের নরম হাওয়ায় জয়নগরের মোয়ার ম ম গন্ধ ছুটছে। মোয়া ব্যবসায়ীদের মুখে লম্বা হাসি। বাজার গরম। বাংলার বাজার উজিয়ে আসাম, ব্যাঙ্গালোর , মুম্বাই , দিল্লি পুনেসহ মোয়া রপ্তানিতে ভারতের যেকোন শহরে বাজারজাত হচ্ছে রমরমিয়ে। সিঙ্গাপুর, ক্যালিফোর্নিয়া, বাহরিন, লণ্ডন, সুইডেন, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়ার মানুষদেরও রসনা তৃপ্তি ঘটাচ্ছে জয়নগরের মোয়া। জয়নগরের বহড়ুর বীনাপানি’- র গণেশ দাস বলছেন-” আমরা দৈনিক ৬৮০ কেজির মতো মোয়া তৈরি করি। রিটেল ছাড়া কলকাতার ৩০ টি সম্ভ্রান্ত মিষ্টি দোকানে আমাদের মোয়া যায়।”শ্যামশুন্দর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এর রঞ্জিৎ ঘোষ বলেন, “আমাদের দৈনিক গড়ে ২৫০ প্যাকেট মোয়া অনলাইনে বিক্রি হয়, খুচরা ছাড়া।” খোকনের মোয়া’র প্রোপাইটার রাজেশ দাস বলছেন, “বছরে ৭৫০০ – ৮০০০ কেজি মোয়া আমরা অনলাইনে দেশ-বিদেশে সরবরাহ করে থাকি।”এই বিপুল বিকিকিনিতে ক্রমান্বয়ে রামকৃষ্ণ, বীণাপানি শ্যামসুন্দর এবং খোকনের মাকালী সুইটস মিষ্টান্ন দোকানগুলি অবস্থান করছে। উল্লেখ্য, জয়নগর ও সন্নিহিত এলাকায় ১০০০ এর ও বেশি অস্থায়ী দোকান থাকলেও বহড়ুও জয়নগরে ২১ টির মতো স্থায়ী দোকান মূল জয়নগরের মোয়ার ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করছে। কথিত আছে, আজ থেকে ১৫০ বছর আগে বহড়ুর যামিনী বুড়ো জয়নগরের রাধাবল্লব জিউর মন্দিরের প্রাঙ্গণে দোল উৎসব উপলক্ষে মেলাতে প্রথম নিজের তৈরি খইয়ে নলেন গুড় মিশিয়ে মোয়া বানান। পরবর্তীতে এই বিশিষ্ট জনপদের দুই বন্ধু ক্রীড়াবিদ্ নিত্যগোপাল সরকার এবং পূর্ণচন্দ্র ঘোষ মিলে ৯০ বছর আগে মোয়ার যথার্থ বাজারজাত করবার পথ তৈরি করেন, যা ইতিপূর্বে বুঁচকী বাবুর মোয়া বলে সমধিক পরিচিতি পেয়েছে।জি.আই স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই খাদ্যপ্রসাধন’কে বাজার সরকারের উঠোনে আনতে অত্যাবশ্যক পণ্যগুলো হলো খই, নলেন গুড়, সঙ্গে লাগে উন্নতমানের ঘি, কিসমিস, কাজু, খোয়া ক্ষীর ইত্যাদি।
এ পর্যন্ত ৫০০০ প্রকার ধানের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হলেও সব ধানে খই হয় হয়তো। কিন্তু সব খইয়ে জয়নগরের মোয়া হয় না। কক্সবাজার, চট্টোগ্রাম পার্বত্য এলাকায় বিন্নিধানেও খই পাওয়া যায়। কিন্তু জয়নগর, ও সন্নিহিত এলাকায় মরিশাল ও কনকচূড় ধানের খইয়ের সুবাসিত ঘ্রাণও স্বাদের জন্য জয়নগরে মোয়া শিল্পে একমাত্র নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছে।
এখানকার প্রসিদ্ধ নলেনগুড়ের গুণগত মানই জয়নগরের মোয়াকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে মিষ্টি পেটুক জনমনে বিশেষভাবে আকর্ষিত হয়ে আসছে। খেজুর গাছকে দু’তিনদিন জিরেন দেওয়ার পর প্রথমদিনে কাটা কাঠের তৈরি নলবাহিত রসই হলো জিরেনকাঠের রস। এই স্বচ্ছ কাঁচের মতো থিকথিকে রস চৌকো উনুনে পর্যাপ্ত জ্বালদিয়ে তৈরি হয় নলেনগুড়। সমগ্র জয়নগর এবং পার্শ্ববর্তী মন্দিরবাজার, মথুরাপুর, মগরাহাটের শিউলিরা সোম – শুক্রবারে বহড়ু ও গঞ্জের বাজারে কাকভোরে এসে গুড় বেচেন। ৭০ – ১০০ শিউলি দূরদূরান্ত থেকে এসে গুড় বিকিকিনি করে।
ফুটিগোদার সারুদ্দিন শিউলিকে এই পেশা কতটুকু কর্ম নিশ্চয়তা দিচ্ছে জানতে চাইলে বলেন, ”মরশোমে ৫ লাখ টাকা বিক্রিবাটা করলি ১ লাক থাকে। ৫/৬ জন খেটে কিছু হয় না। খৈয়ামারার হাকিম ভাই বললেন, “পাঁচ পিঁড়ি ধরে খাজুর গাছ কাটি, কিছু করতে পারিনি। বাবাকেলে কাজ তাই ছাড়তি পারিনা।”
জয়নগরের বহড়ু, শ্রীপুর, তুলসীঘাটা, নিমপীঠ এলাকায় মোয়া তৈরিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খই উৎপাদন হয়ে থাকে। বহড়ুর মল্লবপুরের তরু কয়াল, ছেলে বাপ্পা কয়াল এবং নেপাল দাসরা পারিবরিক ঐতিহ্য হিসাবে খই ব্যবসাকে ধরে রেখেছেন। তরু কয়াল বললেন, ”মরশুমে ২০০ বস্তা থেকে ৩০০ বস্তা কনকচূড় ধানের খই বিক্রি করি। বাকি মাসগুলো কাজ হারিয়ে ফেলি। নেপালদা শরীর হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর স্ত্রী রাজেশ্বরী দাস খইয়ের ব্যবসা কোনরকমে চালিয়ে যাচ্ছেন। মরশুমে ১৫০ – ২০০ ধানের খই বেচেন। অবশিষ্ট সময়ে সবজি ক্ষেতে শ্রমিকের কাজ করেন।
কাশীনগর, কুলপি, রায়দীঘি, শ্যামপুর এলাকার চাষীদের কাছ থেকে কনকচূড় ধান কেনা হয়। বস্তা প্রতি ১২০০ টাকা দাম। জয়নগরের তুলসীঘাটা, শ্রীপুর, খেজুরতলা, খৈয়ামারা, ময়দা, ফুটিগোদা, সাহাজাদাপুর, এবং মগরাহাটের যুগদিয়া-বেনীপুর, গোকর্ণীতে শিউলিরা গুড় তৈরি করছে। অল্প দামে গুড় বেচে তারা দেউলিয়া হয়ে উৎসাহ হারাচ্ছেন।
বর্তমানে মোয়ার চাহিদা আকাশ ছোঁয়া। কেজি প্রতি ৩০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। নলেনগুড়ের পাটালি ২৫০ টাকা কেজি। খেজুরগাছ ক্রমাগত কমছে। প্রয়োজনের তুলনায় গুড় উৎপাদন কমছে। অথচ মোয়ার চাহিদা বাড়ছে। আগামী দিনে এই শিল্পে ভাটা পড়া প্রবল সম্ভাবনা।
গুড়ের পুনরুৎপাদন বাড়ানোর জন্য জয়নগর এবং সন্নিহিত এলাকায় খেজুরগাছ লাগানো, তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কর্মহারা মোয়া শ্রমিকদের দেওয়ার কথা বলেছেন জেলা মিষ্টি উদ্যোগ সমিতির উপদেষ্টা ভবানী সরকার।
বহড়ু বীনাপানি’র গণেশ দাস, শ্যামসুন্দর এর রঞ্জিৎ ঘোষরা বলেছেন, আমরা ২০/২৫ জন গড়ে শ্রমিকদের সারা বছরের কাজ দিয়ে থাকি। কিন্তু জয়নগরের দুই ব্লকের ২০০০০ এর বেশি শ্রমিক এলাকার বাইরে কলকাতাসহ বিভিন্ন জেলা শহরে গিয়ে ব্যবসা করলেও মরশুম বাদ সবাই পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে যায়।
জয়নগরে মোয়া হাব হয়েছে। মোয়া টেস্টিং যন্ত্র বসেছে। বাণিজ্যিকীকরণের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হচ্ছে ক্রমাগত।
তবু এক অশুভ দুর্গতি দৃষ্ট হচ্ছে।
এখানে উল্লেখ্যভাবে প্রযোজ্য যে, সরকার এবং স্থায়ী মোয়া ব্যবসায়ীদের সক্রিয় সহযোগিতায় সরকারি এবং চাষিদের আপাত পতিত জমিতে খেজুরগাছ লাগানো এবং স্ব- নিযুক্তি প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিক সরকারি সাহায্য এবং এবং কর্মহারা মোয়া শিল্পীদের জীবনবীমার অন্তরভূক্তি খুব জরুরি এবং তাদের সরকারি ১০ ০ দিনের কাজের মধ্যে নিযুক্তি খুব প্রয়োজন। তা না হলে বসিরহাট, নদিয়া, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর থেকে আগত বিকল্প খেজুর গুড় জয়নগরের বাজার দখল করবে অচিরেই। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে নকলে বিকল হবে ‘জয়নগরের মোয়া’, যার প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আমাদের হাতে থাকবে না।