গোপাল শীল, রাইদীঘি :সেটা ছিল বসন্তের একটা দিন। সালটা ছিল ২০১৭, ১১ই ফেব্রুয়ারি একজন সহকারী শিক্ষক হিসেবে রায়দিঘি শ্রীফলতলা জুনিয়র বেসিক স্কুলে যোগদান করেন শ্রী তাপস খাঁ। তিনজন শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ৭৩ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে শীর্ণকায় একটি বিদ্যালয়ের দায়িত্বভার নেন। ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারিতে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাপস বাবু। শুরু হয় স্বপ্নের পথ চলা। কোন ভালো স্কুলের ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা সেইসময় ছিল না। সেই অনভিজ্ঞ সাদা চোখেই পরিকাঠামগত উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তিনি। স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে নানা পদক্ষেপ নিতেও শুরু করেন।

ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ছাত্র -ছাত্রীদের মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য একটু স্বতন্ত্র কক্ষ। প্রতিটি ঘরে পর্যাপ্ত আলো ও পাখার ব্যবস্থা শ্রেণীকক্ষ গুলিকে উজ্জীবিত করছে প্রতিনিয়ত। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য জলের ব্যবস্থা, আলাদা একটি অফিস কক্ষ, ফুলের বাগান, খেলার মাঠ, স্কুলের জৌলুস বাড়িয়েছে। নির্মিত হয়েছে একটি সুন্দর শিশু উদ্যান, যার নাম দেওয়া হয়েছে “কিশলয়”। ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ৬। রয়েছে দুটি কম্পিউটার সহ একটি কম্পিউটার কক্ষ। এসব সম্ভব হয়েছে গ্রাম শিক্ষা কমিটি এবং অভিভাবক বৃন্দের ঐকান্তিক সহযোগিতায়।বিদ্যালয় পরিচালন কমিটির সভাপতি শ্রী সুখেন মন্ডলের উদ্যোগী ভূমিকা অনস্বীকার্য।
অভাব রয়েছে অনেক কিছুই। পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, পর্যাপ্ত শ্রেণীকক্ষ নেই, নেই কোন অনুষ্ঠান কক্ষ। বাহ্যিক সৌন্দর্য সবটা ফুটিয়ে তোলা হয়ে ওঠেনি এখনও।

বাকি আছে অনেক কিছুই। এত কিছু “না”এর মাঝে যা রয়েছে তা হলো মুক্ত বাতাস এবং শিশু বান্ধব পরিবেশ। চারিদিকে রোপন করা হয়েছে নানান ফলের গাছ, ফুলের গাছ, পাতাবাহার, সুপারি গাছ, দেবদারু প্রভৃতি।
ইতিমধ্যে এই রায়দিঘি শ্রীফলতলা জুনিয়র বেসিক স্কুল নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে ২০২২ এর ৮ই আগস্ট। ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক শ্রী তাপস খাঁ বলেন, “এই পুরস্কার শুধু একটি পুরস্কার নয়।ধারাবাহিক দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার পত্র। এই পুরস্কারকে সামনে রেখে এগিয়ে চলতে হবে আগামী দিনে।এই পুরস্কার কোন ব্যক্তির নয়, সকল শিক্ষক শিক্ষিকা, ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক অভিভাবিকা এবং প্রতিদিন মিড ডে মিলের সঙ্গে যুক্ত যারা তাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল এই নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কার। তাই এই পুরস্কার আমাদের সকলের।
তবে এই পুরস্কারের পিছনে ছিল দীর্ঘ পরিশ্রম ও পরিকল্পনা। এই বিদ্যালয়ে আসা অবধি দেখেছি ছাত্রছাত্রীরা রোদ বৃষ্টিতে বারান্দায় বসে খাচ্ছে। বিবেক মঞ্চ নামে একটি মঞ্চ ছিল। কিন্তু কোন অনুষ্ঠান সেখানে হয়নি ।খেলাধুলার মাঠ রয়েছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে খেলাধুলা হয় না। ২০১৯ সালেই প্রথম বাৎসরিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হলো এই মঞ্চে।
অভিভাবক – অভিভাবিকাদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। খুব প্রশংসিত হয় স্থানীয় মানুষজনের কাছে।
২০২০ এবং ২০২১ – দুটি ভয়ংকর লকডাউন এর দুঃসময় কাটিয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে উদযাপন করা হলো বিদ্যালয়ের ৮০ বছর পূর্তি।

১৯৪২ থেকে ২০২২ এই দীর্ঘ ৮০ বছরের ইতিহাসকে একত্রিত করা যায়নি কারণ বিদ্যালয়ের নথি সংরক্ষণ প্রক্রিয়া বিস্তর ক্ষতিগ্রস্ত। তবুও সাধ্যমত ইতিহাস তুলে ধরবার চেষ্টা করা হয় তিন দিন ব্যাপী সেই পূর্তি অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রামকৃষ্ণ মিশন গোলপার্ক এর সচিব স্বামী সুপর্ণা নন্দজী মহারাজ। অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করেন তিনি। তিনি বলেন, “সুস্থ জাতি গড়ে তুলতে হলে প্রাথমিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে মায়েদের। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে পরিকাঠামগত উন্নয়ন ঘটিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে প্রাথমিক শিক্ষাকে। উপস্থিত ছিলেন বিধায়ক আলোক জলদাতা। তার বক্তব্যে উঠে আসে বিদ্যালয়ের নানান পরিবর্তনের কথা। তিনি আশা করেন আগামী দিনে বিদ্যালয়ের আরো উন্নতি সাধিত হবে ।
বিদ্যালয়ের দুর্বল ছাত্র-ছাত্রীদের কথা ভেবে বিদ্যালয় শুরুর আগে একটি ক্লাস চালু করা হয়েছে যার নাম দেওয়া হয়েছে “আলো”।
ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে প্রতি সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে তুলসী পাতা খাওয়ানো হয়। তুলসী পাতা যোগানের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে একটি তুলসী বাগান। বাগান পরিচর্যার দায়িত্ব বিদ্যালয়ের শিশু শিক্ষার্থী তথা শিশু সংসদের এবং ছয়টি হাউসের বিভক্ত ছাত্র-ছাত্রীদের। আর এসব সম্ভব হয়েছে শ্রীমতি রিনা প্রামানিক, শ্রী তরুণ কুমার পাইক, মো: নুরউদ্দিন লস্কর, শ্রী চিরঞ্জিত প্রামানিক এবং শ্রীমতি রেবতী ময়রা মন্ডলদের মত দক্ষ ও আন্তরিক সহ শিক্ষক মন্ডলীর সৌজন্যে ।

গত ১৪ ই আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়ে গেল নির্মল সাথী অভিযান ২০২৩। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মথুরাপুর-২ সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক জনাব নাজির হোসেন, সঙ্গে ছিলেন যুগ্ম সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক শ্রী পার্থ রায়। তাদের দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ বিদ্যালয়ের দায়বদ্ধতাকে আরো দৃঢ় করেছে বলে জানান বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষরা।
আজ এমন একটি দিনে জন্মোৎসব (মাসিক) এবং পঠন উৎসব উপলক্ষে সম্প্রতি একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হয়ে গেল এখানে। ছিল ২৭ জন ছাত্র – ছাত্রীর সাড়ম্বর জন্মদিন পালন। ছিল পঠন উদ্যোগ, এসো পড়ি আর গল্প বলি, পঠনকেন্দ্রিক প্রদর্শনী প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন শিশু সাহিত্য পরিচিতি, সংবাদপত্র পরিচয় ও কুইজ। পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয় এর শিক্ষক শ্রী গিরিধারী চক্রবর্তীর পরিচালনায় কুইজ পর্ব ভীষণ মনোগ্রাহী হয়ে ওঠে। প্রদর্শনী প্রতিযোগিতার বিচারক মন্ডলীর আসন অলংকৃত করেন একদল উদ্যোগী অভিভাবিকা। সব মিলিয়ে অনুষ্ঠানটি শিশু মনে একটি উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে।
পরিশেষে রায়দিঘি শ্রীফলতলা জুনিয়র বেসিক স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বলেন, আমাদের শিশু শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকেই আগামী দিনে এক একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে গড়ে উঠুক। বাংলার প্রাথমিক শিক্ষা ভারতবর্ষের সেরা হয়ে উঠবে। আমাদের বিদ্যালয় এর মুকুটে আরো পুরস্কারের পালক গ্রথিত হবে – এই প্রত্যাশাই রাখি।